আলসার নির্মূলে করনীয়

পোস্ট টি ভালো লাগলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন

আলসার নির্মূলে করনীয়

আলসার মানে ক্ষত বা ঘা। কিন্তু পেপটিক আলসার-এর অর্থ হল পেটের (বিশেষত খাদ্যনালির) মধ্যে হওয়ার আলসার। পেটরোগা বাঙ্গালিদের মধ্যে আলসারের সমস্যার হার তো এখন অনেক উপরে। খাওয়ার অনিয়ম, ফাস্ট বা জাঙ্ক ফুড কিংবা অতিরিক্ত ঝাল-মশলাদার খাবার –সবই এই রোগের বন্ধু। সাধারণ থেকে জটিল, যে-কোন অবস্থায় এই রোগ খুবই কষ্টকর। সময় থাকতে রোগ নির্ধারণ না-হলে বা উপযুক্ত চিকিৎসা না-হলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। মারাত্নক ব্লিডিং, স্টমাকের দেওয়ালে ফুটো হয়ে যাওয়া এবং খাদ্যনালির পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো  সাঙ্ঘাতিক অবস্থা হতে পারে। তবে ভয় পাওয়ার তেমন কারণ নেই, বাঁচার ও চিকিৎসার পথও সহজ।

রোগ ও তার কারণঃ

খুবই কষ্টকর এই রোগের কারণে কিন্তু একাধিক। শুধু যে খাবারদাবার দায়ী, তা নয়। এর সঙ্গে বা এছাড়াও রোগের মূলে থাকতে পারে হেলিকোব্যাক্টার পাইলরি নামে একটি ব্যাক্টেরিয়ার পাইলরি নামে একটি ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ। তেমনই অতিমাত্রায় পেইন কিলার বা নন স্টেরয়ডাল অ্যান্টি- ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ খাওয়া বিপদের উৎস হতে পারে। এমনকী টিউমার জাতীয় অন্য কোনও রোগের ফলে পেটের অ্যাসিড ক্ষরণ স্বাভঅবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণে হলেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারণ যেমন একাধিক, রিস্ক ফ্যাক্টরও কম নেই। অন্যদের তুলনায় কিছু কিছু মানুষের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা কিঞ্চৎ বেশি। যেমন, পেপটিক আলসারের পারিবারিক ইতিহাস, লিভার, কিডনি বা ফুসফুসের সমস্যা, মদ্যপানে আসক্তি এবং বাড়তে থাকা বয়স।

রোগের রকমফেরঃ

পেপটিক আলসার আবার দু’ রকম-গ্যাস্ট্রিক আলসার ও ডিয়োডেনাল আলসার। যখন আলসার পেট বা স্টমাকে থাকে, তখন তাকে  বলা হয় গ্যাস্ট্রিক। কিন্তু যখন তার অবস্থান হয় ডিয়োডেনামে (ক্ষুদ্রান্তের মুখ),তখন সেটা ডিয়োডেনাল আলসার। দু’টিই কষ্টকর, তবে গ্যাস্ট্রিকের থেকে ডিয়োডেনাল আলসার আরও বিপজ্জনক। কারণ এর থেকে যখন-তখন অ্যাক্টিভ ব্লিডিং-এর আশঙ্কা থাকে।

উপসর্গঃ

  • সাধারণত দু’টি ক্ষেত্রেই মোটামুটি এক ধরনের-
  • পেটের মধ্যখানে বা উপরের অংশে ব্যথা কিংবা অস্বস্তি ও জ্বালা
  • পেট ফাঁপা
  • বুক জ্বালা অম্বল

কী করবেন, কী করবেন নাঃ

মদ্যপান ও ধূমপানে আসক্তি থাকলে এক্ষনি ছাড়ুন।

অতিমাত্রায় পেইন কিলার, অ্যাসপিরিন বা নন স্টেরয়ডাল ওষুধ খাবেন না।

খাওয়াদাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন। তবে এর মানে ঘুমিয়ে পড়া নয়। রাতে অবশ্য খাওয়ার ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে শুতে যাবেন না।

দিনে অন্তত ১২ থেকে ১৫ গ্লাস পানি খান। এত পেটের অ্যাসিড অনেকটাই নিউট্রালাইজ হবে।

মনে রাখবেন, খাওয়ার এক ঘণ্টা আগে বা পরে কিন্তু পানি খাওয়া নিষেধ। এই নিয়ম মানলে হজম ভাল হয়।

অন্য কোন সমস্যার কারণে কোনও ওষুধ খেতে হলে ডাক্তরকে আলসারের কথা জানিয়ে দিন। নিজে ডাক্তারি করতে যাবেন না।

বমিভাব কিংবা বমি হওয়া বাড়াবাড়ি পর্যায়ে এগুলো হতে পারে-

অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরণের কারণে কালচে রঙের স্টুল পাস হওয়া।

বমির সঙ্গে রক্ত বের হওয়া বা বাদামি রঙের বমি হওয়া।

ওজন কমে আসা।

পেটের ব্যতা আগের চেয়ে আরো তীব্য হয়ে উঠা আবার দু’টি আলসারের আলাদা কিছু উপসর্গও হয়, যেমন-

গ্যাস্টিক আলসারে সাধারণত খাবার খাওয়ার পর কষ্ট শুরু হয়।

ডিয়োডেনাল আলসারে আবার পেট খালি থাকলেই বিপদ, খেলে স্বস্তি!

গ্যাস্ট্রিক আলসারের ক্ষেত্রে অ্যান্টাসিড তেমন সুফল দেয় না, যা ডিয়োডেনাল আলসারের ক্ষেত্র দিয়ে থাকে।

ডায়াগনসিসঃ

প্রথমত, রোগীর অভিযোগ ও উপসর্গ শুনেই বোঝা যায়, আলসার কি না। তেমন মনে হলে, রোগ হাতেনাতে ধরতে ডাক্তাররা কয়েকটি মেডিক্যাল টেস্ট করাতে পারেন।

যেমন, আপার জিআই এন্ডোস্কোপি বা গ্যাস্ট্রোস্কোপি এবং সঙ্গে বায়পসি। অনেক ক্ষেত্রে বেরিয়াম মিল এক্স রে- ও করতে দিতে পারেন। এইচ বাইলরি ব্যক্টেরিয়ার  উপস্থিতি  জানতে স্টুল, ব্যাড ও নি:শ্বাসের পরীক্ষাও করার প্রয়োজন পড়তে পারে।

চিকিৎসাঃ

সময় থাকতে রোগের যথাযথ চিকিৎসা না- হলে বিপদ। তাই রোগ সন্দেহ হওয়া মাত্রই  টেস্ট রিপোর্ট পাওয়ার আগেই সাধারণত চিকিৎসকরা অ্যাসিড ব্লকিং ওষুধ দিয়ে উপসর্গ কমানোর চেষ্টা করে থাকেন। অল্প সময়ের জন্য এই ব্যবস্থা নিয়ে দেখা হয়, কতটা উপকার পাওয়া যাচ্ছে। এর সঙ্গে চলতে পারে কিছু অ্যান্টিবায়োটিক এবং প্রোটন পাম্প ইনহিবিটার্স জাতীয় ওষুধ। পাশাপাশি ডায়েট ও লাইফস্টাইল নিয়ন্ত্রণে রাখাও জরুরি।

এসবেও উপকার না পেলে অপারেশনের পথ ধরতে হবে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এন্ডোস্কোপির মাধ্যমেই ছোটখাট আলসার (যা থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে) সারিয়ে ফেলা যায়।

খাওয়াদাওয়াঃ

আলসার রোগীদের পক্ষে হাই ফাইবার ডায়েট জরুরি।

ভারী খাবার না-খেয়ে দিনে ৫-৬ বার অল্প অল্প খান। এতে হজমের চাপ কমে, আবার পেট কখনওই খালি থাকে না বলে অ্যাসিড ক্ষরণ হয়ে স্টমাক লাইনিংয়ের ক্ষত বাড়ে না।

আস্তে আস্তে এবং ভাল করে খাবার চিবিয়ে খাান। এত হজম ভাল হয়।

এড়িয়ে চলুন কাঁচা ফল ও সবজি, কমলালেবু বা আঙুলের মতো টক –মিষ্টি ফল, চিনি দেওয়া খাবার আচার বা টোম্যাটো কেচাপ ও টোম্যাটো এবং মাংস, যাতে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ বেশি।

খেতে পারেন- সিরিয়ালস (ওটস, কর্ণফ্লেক্স, মুয়েসলি ইত্যাদি) অল্প পরিমাণে নুন-চিনি, আপেল, কলা, আম, পেঁপে ও খেজুর । দুধ বা দই খেতে ইচ্ছে হলে লো-ফ্যাট দুধই প্রযোজ্য। সবজির মধ্যে বাঁধাকপি, আলু, গাজর ও ব্রকলি খুবই উপকারী।

ঝাল-মশলা দেওয়া খাবারের মতোই ভাজা বা তৈলাক্ত খাবার এবং চা- কফি (যাতে ক্যাফেন বেশি থাকে ) যতটা সম্ভব কম খান।

আলসার অ্যাটাকের সময় আমিষ খাবেন না, এতে সমস্যা বাড়তে পারে।

এমনিতে আমিষ খেতে হলে দিনে একটা বেশি ডিম খাবেন না। মাছ বা চিকেন খেলও মাটন বা রেড মিট কম খাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

চেষ্টা করুন অলিভ অয়েলে খাবার রেঁধে খাওয়ার।

এধু কিংবা দু’কোয়া রসুন প্রতিদিন খেতে পারলে ভাল হয়।

আলসার রোগীর খাদ্য তালিকাঃ

খাদ্য নির্বাচনের জন্য যেটি সবার আগে করতে হবে তা হল উত্তেজক পানীয় ও অতিরিক্ত এসিড ক্ষরণ হয় এমন খাবার না খাওয়া। ডুবো তেলে ভাজা খাবার একেবারেই পরিহার করা উচিত। এ ছাড়া ডালের তৈরি খাবার পরিপাকতন্ত্রে শোষিত হতে সময় বেশি লাগে বলে এগুলোও বাদ দেওয়া ভালো। নাস্তায় এগুলোর পরিবর্তে খেতে পারেন ভেজানো চিঁড়া-কলা, নারিকেল, চিনি/গুড়, চিঁড়ার পোলাও, নুডলস, আলুর দম, হালকা তেলের তৈরি তেহারি, সঙ্গে খেজুর ও অন্যান্য ফল। ভাত, মাছ, মুগডাল ও আঁশবিহীন সবজি আপনার জন্য উত্তম খাবার। যাদের দুধে সমস্যা হয় না তারা দুধ খেতে পারেন। আর ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স থাকলে দুধের পরিবর্তে ছানা, পনির এসব খেতে পারেন। চা, কফি, সিগারেট, অতিরিক্ত মশলাযুক্ত খাবার, তৈলাক্ত খাবারে আলসার হয়ে থাকে, তাই এগুলো সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য। অতিরিক্ত গরম ও ঠাণ্ডা খাবার না খাওয়াই ভালো। এক্ষেত্রে টকদই, মাঠা, ঘোল, ইসবগুলের ভুসি বেশ ভালো কাজ দেয়। এছাড়া নরম ভাত, আলু সেদ্ধ, সুজি, সাগু, পাতলা মুরগির স্যুপ, বার্লি ইত্যাদি খাওয়া যায়। আলসারের তীব্রতায় শাক, বেশি আঁশযুক্ত খাবার খেলে পেটের ফাঁপা ভাব বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই হালকা খাবার, যা সহজে হজম হয় এমন খাবার বেশি করে খেতে হবে। খাদ্যতালিকা সঠিক ভাবে মেনে চললে আলসার ভালো হয়ে যাবে। লাইফস্টাইলের পরিবর্তন এনে সহজেই খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সারা দিন আট থেকে ১২ গ্লাস পানি আমাদের পান করা উচিত। সঠিক খাদ্যতালিকা তৈরি করে রোগীকে দ্রুত আরাম দিতে ও রোগের উপশমে আপনার পুষ্টিবিদ সাহায্য করতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

seventeen − thirteen =