ডায়াবেটিস রোগীদের হাড়-জোড়ার সমস্যায় কী করবেন, কী করবেন না

পোস্ট টি ভালো লাগলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন

ডায়াবেটিস রোগীদের হাড় ও অস্থিসন্ধির সমস্যা সাধারণত চল্লিশ বছরের বেশি বয়সী ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। তা ছাড়া হৃদরোগ, হাইপোথাইরোডিজম, স্ট্রোক, ভারী কাজ করা, কাঁধের আঘাত—এসব কারণে ঝুঁকি আরও বেড়ে যেতে পারে। ডায়াবেটিস দেহের প্রতিটি সিস্টেমকেই ক্ষতিগ্রস্থ করে। দীর্ঘ দিনের ডায়াবেটিস চোখ, কিউনী, হৃৎপিন্ড, স্নায়ুতন্ত্র, ত্বক, সন্ধি বা জয়েন্ট, প্রজননতন্ত্র সহ দেহের প্রতিটি তন্ত্রই তার স্বাভাবিক কার্যকারিতা হারিয়ে রোগক্রান্ত হবে।

ডায়াবেটিস রোগীর মাংসপেশীর কর্মক্ষমতা আস্তে আস্তে কমে আসে, পাশাপাশি ডায়াবেটিস নিউরোপ্যাথি হলে হাত ও পায়ের মাংশপেশী প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগী হাটাঁহাঁটি ও হাতের কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এছাড়াও শরীরের প্রায় প্রতিটি হাড় ও জোড়ায় আক্রান্ত হতে পারে।

জোড়ার ভিতর বিভিন্ন ক্রিয়া বিক্রিয়ার ফলে জোড়া ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে অকেজো হয়ে পড়ে। যার ফলে জোড়ায় ব্যথা হবে, ফুলে যাবে, হাটা চলাফেরা, কাজকর্মে ব্যথা তীব্র থেকে তিব্রতর হয়। রোগীর নামাজ, গোসল, জামা কাপড়, পরিধান করতে, টয়লেট ব্যবহার করতে দৈনন্দিন কাজ কর্মে মারাত্মক অসুবিধার সম্মুখিন হয়। অনেক সময় মাংসপেশীর অসাড়তা এবং হাড় ও জোড়ার ক্ষতি হওয়ার ফলে রোগী পড়ে গিয়ে হাড় ও জোড়া ভেঙ্গে যায়। দীর্ঘদিন রোগ ভোগের কারনে রোগী এক পর্যায়ে পঙ্গুত্ব বরন করে।

ডায়াবেটিক রোগীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেকোনো স্থানে নানা ধরনের জটিলতা হতে পারে। কিডনি, চোখ, হদ্যন্ত্র, রক্তনালি, স্নায়ু ইত্যাদির সমস্যা তো হয়ই—অস্থিসন্ধি, অর্থাৎ হাড়ের জোড়ায়ও কিছু সমস্যা হতে পারে। ২০ থেকে ৪০ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগী জীবনের কোনো-না-কোনো সময়ে এসব সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন। রক্তে শর্করার মাত্রা অনিয়ন্ত্রিত থাকলে জটিলতা বাড়ে। প্রকারভেদে এ রকম সমস্যা সারতে ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত লাগতে পারে।

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মতো হাড়, অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে জটিলতা তৈরি করতে পারে।

ডায়াবেটিসজনিত অস্থিসন্ধির যেসকল সমস্যা হতে পারে—

  • ফ্রোজেন শোল্ডার
  • ট্রিগার ফিঙ্গার
  • প্লান্টার ফ্যাসাইটিস
  • সারকোট জয়েন্ট
  • অস্টিও আর্থ্রাইটিস
  • ডায়াবেটিক চিরোআর্থ্রোপ্যাথি
  • কারপাল টানেল সিনড্রোম
  • গেঁটে বাত

বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো হাড়, জোড়া, তরুনাস্থি, জোড়ার আবরণ(ক্যাপসুল), লিগামেন্ট, পেশী ও টেনডন ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হয়। হাড় ব্যথা, হাড় নরম হওয়া, বেঁকে যাওয়া ও ভঙ্গুরতার প্রবণতা দেখা দেয়। কবজি ও কটির জোড়ার হাড় এবং মেরুদণ্ডের হাড়(কশেরুকা) ছোট হয়ে যায় এবং অল্প আঘাতেই ভেঙে যায়। হাত ও আঙুলের চামড়া পুরু ও মোমের মতো হয় এবং হাত ও আঙুলের নড়াচড়া সীমিত হয়ে যায়। আঙুল ও তালুর টিস্যু সঙ্কোচনের ফলে তালু শক্ত ও আঙুল বাঁকা হয় এবং সোজা করা যায় না। ওজন বহনকারী বড় জোড়াগুলো বিশেষ করে হাঁটু, কটি ও গোড়ালির জোড়ার তরুনাস্থি ক্ষয় হয়। ফলে জোড়া ফুলে যায়, ব্যথা হয়, জমে যায় এবং মাঝে মাঝে জোড়া আটকে যায়, অস্বাভাবিক অবস্থা বা স্থানচ্যুতি হয়। কাঁধের পেশী ও টেনডনের প্রদাহ হয়, ব্যথা এবং স্বতস্ফুর্ত বা অল্প আঘাতেই ছিড়ে যায়। হাত সামনে বা পাশে উঠাতে কষ্ট হয়। হাত দিয়ে জামার বুতাম লাগানো যায় না। মাথার চুল আঁচড়ানো কষ্টকর। প্যান্টের পেছনের পকেটে হাত দেয়া ও পিঠ চুলকানো যায় না। কখনো কখনো কাঁধ জমে যায় এবং কোনো নাড়াচাড়া করা যায় না। গোড়ালি ও কবজির পেশী ও টেনডনের প্রদাহ হয় এবং অল্প আঘাতেই ছিঁড়ে যায়। হাতে ব্যথা হয় এবং হাত দিয়ে কিছু তোলা, গ্লাস ধরা, দরজা খোলা এবং ভেজা কাপড় নিংড়ানো কষ্টকর হয়। গোড়ালির পেশী ও টেনডনের প্রদাহ এবং ছিঁড়ে যাওয়ার জন্য ব্যথা হয় এবং হাঁটা, জগিং ও দৌড়ানো যায় না।

প্রতিকার বা চিকিৎসা:

ডায়াবেটিস রোগ যেমন খাদ্যভাস, শারীরিক পরিচর্যা ও চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তেমনি বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা এবং দৈনন্দিন জীবনব্যবস্থা পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিসজনিত হাড় ও জোড়ার সমস্যা থেকে নিরাময় হওয়া সম্ভব। প্রাথমিকভাবে ব্যথা ও অস্বিস্থিকর অবস্থা দূর করতে হবে, জোড়ার জমাট অবস্থা ভালো করতে হবে এবং জোড়াকে অতিরিক্ত ক্ষতি হতে রক্ষা করতে হবে। তবে চিকিৎসা প্রদানের পূর্বে রোগীকে ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন।

কীভাবে রক্ষা পাবেন:

  • শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
  • প্রতিদিন নিয়মিত হাঁটুন বা শরীরচর্চা করুন।
  • নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম করুন।
  • ব্যথা বেশি হলে সাময়িক বিশ্রামে থাকুন।
  • অযথা ব্যথার ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডায়াবেটিস রোগীদের এমনিতেই কিডনি জটিলতার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ব্যথার ওষুধ সেবনে এটি ত্বরান্বিত হতে পারে।
  • সমস্যার ধরন অনুযায়ী চিকিৎসকের পরামর্শে ঝুঁকিপূর্ণ নড়াচড়া ও অভ্যাস পরিবর্তন করুন।
  • প্রয়োজনে জোড়ার উপর চাপ কমানোর জন্য হাতে ওয়াকিং স্টিক, উঁচু চেয়ারে বসা, ব্রেচ বা হাঁটু সাপোর্ট, কোমরে বেল্ট ও কুশনযুক্ত জুতা ব্যবহার করলে কোমর, কটি ও হাঁটুর ব্যথা কম হবে।
  • জোড়ায় স্বাভাবিক নড়াচড়া ও পেশী শক্তিশালী হওয়ার ব্যায়ামে জোড়া জমে যাওয়া লাঘব করে।
  • গেঁটে বাত প্রতিরোধ করতে হলে বেশি পিউরিন আছে এমন খাদ্য বর্জনীয়। (পিউরিন সমৃদ্ধ শাক-সবজি ও বীচি জাতীয় খাবার যেমনঃ বিভিন্ন ডাল, বীচি, মাশরুম, পালং শাক, সীম, বরবটি, ফলের মধ্যে আম, কলা, সফেদা, খেজুর, কিসমিস, আখ, তাল ইত্যাদি। এছাড়াও অতিরিক্ত চিনি খেলেও ইউরিক এসিড বেড়ে যাওয়ার প্রবনতা ত্বরান্বিত হয়।)
  • খাদ্যভাস, শারীরিক পরিচর্যা ও ওষুধের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
  • ডায়াবেটিক খাদ্য তালিকা অনুসারে পরিমাণমতো ফল, শাক-শবজি, কম ক্যালরি, কম সুগার ও কম চর্বিযুক্ত খাবার, শিম, মটরশুটি, চর্বিবিহীন মাংস, বাদাম ও অক্ষত খাদ্যশস্য ইত্যাদি খেতে হবে।
  • সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা কম করতে হবে।
  • একটানা বেশিক্ষণ বসে থাকা যাবে না।
  • সমতল জায়গায় হাঁটাহাঁটি করতে হবে।
  • গরম ও ঠান্ডা সেঁক ব্যবহারে পেশীর সঙ্কোচন কমবে, রক্ত চলাচল বাড়বে এবং ব্যথা কমবে।
  • ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস ছাড়তে হবে।
  • অবশ্যই নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

তাই ডায়াবেটিসের কারনে শরীরের বিভিন্ন অসাড়তা, হাড় ও জোড়ার ব্যথায় ব্যথানাশক ঔষধ মোটেও খাওয়া উচিত নয়। এতে করে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও স্ট্রোক জনিত প্যারালাইসিস কিডনী অকেজো হওয়া, গেসটিক, আলসার ইত্যাদি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

এক্ষেত্রে রিহেব-ফিজিও পার্শ প্রতিক্রিয়া বিহীন অত্যান্ত আধুনিক চিকিৎসা। রোগী একজন বিশেষজ্ঞ রিহেব-ফিজিও চিকিৎসকের শরনাপন্ন হয়ে চিকিৎসা নিলে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠবেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগীর শারীরিক অক্ষমতায় পরিমান নির্নয় করে বিভিন্ন থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ, ইলেকট্রো মেগনেটিক রেডিয়েশন, ম্যানুয়েল ও ম্যাকানিকেল থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা দিলে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ থাকবে। সেক্ষেত্রে ডায়াবেটিস রোগীকে ভয় না পেয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে।

ডা. মো: সফিউল্যাহ্ প্রধান

বাত ব্যথা প্যারালাইসিস ডিসএবিলিটি ও রিহেব-ফিজিও বিশেষজ্ঞ

ডিপিআরসি হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক ল্যাব লি:

১২/১ রিং-রোড, শ্যামলী, ঢাকা-১২০৭, (শ্যামলী ক্লাব মাঠ সমবায় বাজারের উল্টো দিকে)

সিরিয়ালের জন্য ফোন: ০৯ ৬৬৬ ৭৭ ৪৪ ১১ অথবা ০১৯৯-৭৭০২০০১

মেডিকেলবিডি/আরএম/ ১৮ মে, ২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

ten + 12 =