পানির অপর নাম জীবন। জীব জগতের অস্তিত্ব রক্ষায় সবচেয়ে কার্যকর ভুমিকা রাখছে পানি। পানি আমাদের পিপাসার্ত হৃদয়কে পরিতৃপ্ত করে। পানি মহান প্রতিপালকের এক অপার দান, পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণের মৌলিক উপাদান। রাসায়নিকভাবে পানি হলো H2O; এটি সার্বজনীন দ্রাবক। তাই পানি সর্বপ্রকার দূষিত পদার্থকে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশুদ্ধ পদার্থে পরিণত করে, পরিবেশ ও জীবকুল ওক্ষা করে থাকে।
ভূপৃষ্ঠেরপ্রায় ৭৫ শতাংশ পানি দ্বারা আবৃত। পৃথিবীর মোট পানিসম্পদের শতকরা ৯৭ ভাগ হলো লবণাক্ত পানি আর বাকি ৩ ভাগ স্বাদু বা মিঠাপানি। একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য সুপেয় পানির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। USA Environment Protection Agency- এর সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, স্বাভাবিকভাবে একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষের প্রতিদিন দু-তিন লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। এ ছাড়াও নৈমিত্তিক জীবনে সুপেয়ে পানির নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে।
২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস। ২০১৮ সালে এই দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে ‘Nature for Water’ অর্থাৎ ‘প্রকৃতির জন্য পানি’। প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য পানি অপরিহার্য। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় এনে প্রাণী ও ঈস্খকৃতির একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য পানির প্রাকৃতিক উৎস খোঁজার এই উদ্যোগ। প্রতিপাদ্যটি যথার্থ হয়েছে। কেননা বর্তমান বিশ্বে প্রায় বিলিয়ন মানুষ নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করে চলেছে। এ লক্ষ্যমাত্রায় আরো আছে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা ও দূষণ হ্রাসের গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা।
জীবনের জন্য পানি অপরিহার্য
সুপেয়ে পানি বা স্বাদু পানি (Fresh Water) এক ধরনের পানি, যাতে লবণ নেই বা থাকলেও তাতে লবণের পরিমাণ খুবই কম। নদী, হ্রদ, তুষারপাত, বরফ ও বৃষ্টি ইত্যাদি পানিবাহী মাধ্যমগুলো স্বাদু পানির প্রধান উৎস। পানি ছাড়া জীবন ধারণ অসম্ভব। পরীক্ষাগারে দুই অণু হাইড্রোজেনের সাথে এক অণু অক্সিজেনের মিশ্রণ ঘটিয়ে এক অণু পানি উৎপাদন করা সম্ভব হলেও পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষের জন্য পরীক্ষাগারে পানি উৎপাদন করে সরবরাহ করা কল্পনাতীত বিষয়। মহান প্রতিপালক পানিকে তাই সব প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য অবারিত করেছেন। পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা নহলের ১৮২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন- ‘তিনি (আল্লাহ) আসমান থেকে তোমাদের জন্য পানি বর্ষণ করেন, তার কিছু অংশ তোমরা পান করো আর কিছু অংশ দিয়ে গাছপালা জন্মায়, যাতে তোমরা জন্তু-জানোয়ার প্রতিপালন করতে পারো। আর পানি দ্বারা তিনি তোমাদের জন্য শস্য উৎপাদন করেন’। পানি মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে সৃষ্টির প্রতি করুণার বারিধারা। পবিত্র কুরআনের বাণী অনুযায়ী এই পানিতেই রয়েছে জীবনের স্পন্দন, রয়েছে জীবনধারণের আহার্য। তাই পানিকে কারণে-অকারণে অপচয় ও দূষণ করা সৃষ্টির প্রতি অবিচার ও অত্যাচার বৈকি?
প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পানি অপরিহার্য:
মানুষসহ সব প্রাণীর খাদ্য ও জীবন ধারণের বাহক হিসেবে পানির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। যেসব কারণে প্রাণীর জন্য পানি অত্যাবশ্যকীয়:
- কোষের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশ;
- বংশ বিস্তার স্বাভাবিক রাখতে;
- শরীরে বিভিন্ন বিষক্রিয়া ধ্বংসের জন্য;
- দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে;
- খাদ্যদ্রব্য হজম ও অপ্রয়োজনীয় উপাদান অপসারণে;
উদ্ভিদের জীবনে নিরাপদ পানির গরুত্ব:
উদ্ভিদের জীবন রক্ষার জন্য সুপেয় পানির গরুত্ব অপরিসীম। যেমন-
- বীজের অঙ্কুরোদগম;
- উদ্ভিদের সার্বিক বেড়ে ওঠা;
- পরাগায়ন ও ফল ধারণের জন্য;
- বীজের বিস্তার প্রভৃতি কাজে সুপেয় পানি অপরিহার্য।
পানি দূষণের প্রধান কারণ
- পুকুর বা নদীর পানিতে বাসনকোসন মাজা, ময়লা কাপড় ধোয়া, গরু-মহিষ গোসল করানো, পাট পচানো, পায়খানা-প্রস্রাব করা, প্রাণীর মৃতদেহ পানিতে ফেলা এসব কারণে পুকুর, নদী ও খালবিলের পানি দূষিত হয়।
- কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড ও ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর মলমূত্র, বিছানাপত্র ও জামাকাপড় পুকুর, কুয়া, খালবিল বা নদীর পানিতে ধুলে রোগজীবাণু মিশে পানি দূষিত হয়।
- কলকারখানার বর্জ্য, ট্যানারি, রঙ করখানা, টেক্সটাইল, গার্মেন্টসসহ বিবিধ শিল্পবর্জ্য পানিতে মিশে পানি দূষণ করছে। ঢাকা মহানগরীর আশপাশের শিল্পকারখানার পাশের নদীনালা ও খালবিল, পাটি, বায়ু সবই দূষণের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
- কৃষিকাজে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করলে তা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে খালবিল ও নদীর পানিতে মিশে পানকে দূষিত করে।
- বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের সময় গ্রাম ও শহরাঞ্চল পানিতে ডুবে যায়। এতে মানুষ ও গৃহপালিত পশুপাখির মলমূত্র পুকুর, কুয়া ও নলকূপের পানিতে মিশি পানযোগ্য পানিকেক দূষিত করে।
পানিতে আর্সেনিক দূষণ জনস্বাস্থ্যে জন্য বড় হুমকি
পানিতে আর্সেনিক বিষাক্ততা পৃথিবীর ইতিহাসে অত্যন্ত খারাপ গণবিষাক্ততা বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানির আর্সেনিক দূষণ একটি স্বীকৃত জাতীয় সমস্যা। দেশের প্রায় ৭৫ মিলিয়ন মানুষ আজ আর্সেনিক দূষণের হুমকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন দেশী-বিদেশী সংস্থার সহায়তায় National policy to Arsenic Mitigation and Implementation Plan বাস্তবায়নের পরও প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ মানুষ আর্সেনিকোসিস (Arsenicosis) রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর্সেনিক দূষণ শরীরে ধীরে ধীরে হয় বলে মানুষ প্রাথমিক অবস্থায় বুঝতে পারে না। আর্সেনিকযুক্ত পানি দীর্ঘ দিন পান করলে হাত ও পায়ের তালুতে কালচে দাগ বা ফোসকা পড়ে ব্ল্যাক ফুট ডিজিজ (Black foot disease) হয়, তখন মানুষ তার শরীরে আর্সেনিক দূষণ বুঝতে পারে।
পানি দূষণ প্রতিকার ও নিরাপদ পানির জন্য করণীয়
যে পানি মানুষ, উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের জন্য নিরাপদ নয়, তাই দূষিত পানি। একটু সচেতন হলে আমরা এর প্রতিকার করতে পারি। এ ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করা যায়।
আইনসম্মত উপায়ে পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ: পানির বাধাহীন অপচয় ও অদুরদর্শী ব্যবহারে দূষণমুক্ত পানির ভাণ্ডার ক্রমসঙ্কুচিত। এই পরিবেশ সঙ্কটের মধ্যে পানির সদ্ব্যবহার, সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ জরুরি। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রেই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে পানির যথোচিত ব্যবহার ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশেও পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ অ্যাক্ট প্রণয়ন করা আবশ্যক। এই আইনের অধীনে সরকারের পরিবেশ অধিদফতরের অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিশোধন ব্যতিরেকে কোনো তরল বা কঠিন বর্জ্য জলজ পরিবেশে নিক্ষেপ করতে পারবে না। সব সিটি করপোরেশনে পার্শ্ববর্তী নদীর দূষণ প্রতিরোধে কার্জকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সিটি করপোরেশনগুলোর নর্দমার সেন্ট্রাল ইটিপির মাধ্যমে পরিশোধন করে নদীতে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রযুক্তিগত উপায়ে পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ: বর্জ্য বিশোধন প্লান্টের প্রযুক্তি প্রয়োগ করে ভূপৃষ্ঠীয় এবং ভূগর্ভস্থ পানির গুণমান বৃদ্ধি করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে গৃহস্থালি বর্জ্য ও শিল্পজাত বর্জ্য পানিকে পয়ঃপ্রণালীর মাধ্যমে কিংবা সরাসরি খালবিলে বা নদীতে প্রবাহিত না করে বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ প্লান্টে প্রক্রিয়াকরণ করা। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের কঠোর প্রয়োগ করে শিল্প মালিকদের ETP স্থাপনে বাধ্য করতে হবে। কোনো প্রকার শিল্পবর্জ্য বা প্যাথোজেনিক বর্জ্য (মলমূত্র) নদীতে ফেলা যাবে না।
ব্যক্তি উপায়ে পানির দূখু নিয়ন্ত্রণ: ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায়ও পানি দূষণ হ্রাস করা সম্ভব এবং এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা সরকার যতই আইন করুক ব্যক্তি সচেতন না হলে সব পরিকল্পনাই ব্যর্থ হয়ে যায়। পানিতে দূষণ সৃষ্টিকারী বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার না করা, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা না ফেলা, পলিথিন বা মোড়ক পানিতে না ফেলা। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও অধিকমাত্রার ডিটারজেন্ট ব্যবহার না করে আমরা পানিকে দূষণমুক্ত রাখতে পারি। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য, যাত্রাপথে লঞ্চ ও ফেরিঘাটে আমরা ডাব, ঝালমুড়ি, আচার, ডিম, কলাসহ বিভিন্ন ফল ও ফাস্টফুড খেয়ে তার খোসা, প্যাকেট ইত্যাদি নদীতে ছুড়ে ফেলি, এভাবে প্রতিদিন হাজার মানুষ যাত্রাপথে পানি দূষণ করছি, এটি অন্যায়। এসব আচরণ পরিহার করা দরকার।
সম্প্রতি আইনিভাবে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সাগরের জলসীমা বৃদ্ধি পাওয়ায় সমুদ্র সম্পদ তথা ব্লু ইকোনমির অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা বায়লাদেশের প্রধানমন্ত্রী কেষ হাসিনা বারবারই বলে চলেছেন। কাজেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও পানিকে সংশোধন করে তার ব্যবহার বৃদ্ধি করে বাংলাদেশের উন্নয়নকে আরো সুসংহত করতে হবে। সেই সাথে সুরক্ষিত হবে পরিবেশ, আমাদের সুন্দর পৃথিবী রক্ষা পাবে জলবায়ু পরিবর্তনের করাল থাবা থেকে। এবারের ২০১৮ সালের বিশ্ব পানি দিবসে এটি হোক বাংলাদেশের জন্য সচেতনতা সৃষ্টির একটি ক্যাম্পেইন।
 medicalbd সাস্থের সকল খবর।
medicalbd সাস্থের সকল খবর।




 
											 
											 
											 
											 
											