
ব্রেন ক্যানসার
প্রথম দেখা বছর কয়েক আগে কলকাতার ডি.এস.রিসার্চ সেন্টারের ফুলবাগান সেন্টারের নতুন অফিস উদ্বোধনের দিন। সম্ভবত দিনটা ছিল ২০০৯ সালে ২৩ অক্টোবর। কোনও নেতা নয়, মন্ত্রী নয়, কোনও তারকাও নয়, সেদিন সেই ঝাঁ-চকচকে বহুতলে সেন্টারের পথচলা শুরু হয়েছিল একটি বাচ্চা ছেলের হাত ধরে। নাম রূপম সামন্ত। বাড়ি হুগলি জেলার তারকেশ্বর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে মাইল দু’-তিন দূরে সৈতা গ্রামে। কতই বা বয়স তখন তার, বড়জোর ৮ কী ১০ ক্লাস থ্রি-ফোরের ছাত্র। এবারই সেই মোক্ষম প্রশ্নটা, কে সেই ছেলেটা ? কলকতার বুকে এমন একটা ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্র (আয়ুর্বেদ) উদ্বোধনের এই গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক কাজটা সৈঁতার ওই অখ্যাত ছেলেটাকে দিয়েই বা কেন ?
আরও পড়ুনঃ উদ্বেগ রোগ বা অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার।
এ প্রশ্ন দেওয়ার আগে ছোট্র একটা ভূমিকা করে নিতে হবে। ডি.এস.রিসার্চ সেন্টার দেশের একটা নামী আয়ুর্বেদিক ক্যানসার গবেষণা ও চিকিৎসা কেন্দ্র। প্রাচীন আয়র্বেদকে আশ্রয় করে বিশিষ্ট আহার-বিজ্ঞানীদের সঙ্গে নিয়ে দেশের এই নামী গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির গবেষক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকে ও কবিরাজরা দীর্ঘ আজ প্রায় ৫০ বছর ধরে তাদের মূল্যবান গবেষণার পাশাপাশি অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে ক্যানসার-পীড়িত মানষের সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। শুরু থেকেই তাদের গবেষণার মূল বিষয় প্রাচীন আয়ুর্বেদ, মূল উপাদান মানবীয় ভোজ পদার্থ এবং মূল সহায়ক পোষক শক্তি বা নিউট্রিয়েন্ট এনার্জি, যা একই সঙ্গে পুষ্টিদায়ক ও স্বাস্থ্যবর্থক, এর কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ক্ষতিকারক দিকও নেই। এই কেন্দ্রে চিকিৎসা করিয়ে বিগত কয়েক বছরে বহু ক্যানসার পীড়িত মানুষ তাঁদের স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছেন। কোনও বিশেষ ক্যানসারে নয়, লিভার ক্যানসার থেকে প্যাংক্রিয়াস ক্যানসার, ব্রেস্ট ক্যানসার থেকে গলব্রাডার ক্যানসার, মলাশয়, এমনকী ব্রেন ক্যানসারও।
ক্লাস থ্রি-তে পড়ার সময় সৈঁতার এই রূপম সামন্তও আক্রান্ত হয় এই রোগেই। অনবরত আমি। কোনও কিছুতেই কিছু না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ভেলোর। পরীক্ষায় সেখানে দেখা গেলে মাথায় টিউমার। দিনটা ছিল ১৯ আগস্ট, ২০০৩। অপারেশন করা হল, ‘রে’ দেওয়া হল, পরামর্শ দেওয়া হল ‘কেমোথেরাপি’রও। কিন্তু হাসপাতালে পরামর্শ মতো ২ লাখ টাকা জমা দিয়ে ৬ মাস ভোলোরে থেকে চিকিৎসা করানোর মতো ধৈর্য ও আর্থিক সঙ্গতি কোনওটাই রূপমদের ছিল না। ততদিনে বায়োপসি রিপোর্টও চলে এসেছে- ভারমিরাল ডেমুলো ব্লাসটোমা- গ্রেড ফোর। রূপমরা ফিরে ফিরে এল বাড়িতে। রূপমের বাবা-জ্যেঠার মাথায় তখনও ঘুরছে হাসপাতালের পরামর্শের কথা।
আরও পড়ুনঃ উদ্বেগ রোগ বা অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার।
এরই মধ্যে তাঁরা জানতে পারলেন ডি.এস.রিসার্চ সেন্টারের কলকাতা সেন্টারের (পি-২৬, সি.আই.টি রোড, স্কিম-সিক্স-এম, কলকাতা-৫৪) কথা (তখন সেন্টার ছিল বড়বাজারে)। দিনটা ছিল ২০০৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর। তারপরই ধীরে ধীরে শুরু হয় রূপমের স্বাভাবিক হয়ে ওঠার পালা। দীর্ঘদিন পর শুরু হয় টিউশন পড়তে যাওয়া, স্কুল যাওয়া। এমন একটি ভাগ্যবান ছেলেকে দিয়ে ২০০৯ সালে উদ্বোধন করিয়ে সেন্টারের কর্মকর্তারা মানুষকে সেদিন এই বার্তাই দিতে চয়েছিলেন যে ক্যানসার মানেই মৃত্যু নয়। ইচ্ছে থাকলেও তখন ছেলেটাকে নিয়ে লেখার তেমন তাগিদ অনুভব করিনি। মনে হয়েছিল আরও কয়েকটা বছর অপেক্ষা করে দেখা যাক না।
শেষমেশ একদিন দুম করে হাজির হলাম রূপমের সৈঁতার বাড়িতে। তারকেশ্বর স্টেশন থেকে পৌনে এক ঘন্টার পথ। পাকা বাড়ি, উঠোন ময় পরপর দু’জোড়া ধানের গোলা। বড়রা সবাই জমির কাজে ব্যস্ত। নির্ভেজাল একটা কৃষিজীবী পরিবার। রূপম তখন বাড়রি বাগানের পেয়ারা গাছে উঠে পেয়ারা পাড়তে ব্যস্ত। নীচে ফ্রকের আঁচল পেতে বোন রিয়া। সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোর কথা তখন সে মনেও করত পারে না। এখন সে ১৯-২০ বছরের তরুণ, ইতিমধ্যে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।