নিদ্রা ও স্বপ্নের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা

পোস্ট টি ভালো লাগলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন

নিদ্রা ও স্বপ্নের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা

ব্রেইন নিউরন নামে কোটি কোটি স্নায়ুকোষ আছে। রাসায়নিক ও বৈদুতিক সংকেতের মাধ্যমে নিউরন পরস্পরের মধ্যে বার্তা ও তথ্যের আদান-প্রদান করে। তাকে উদ্দীপ্ত করে বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি করে এবং সাথে সাথে একসন (স্নায়ুকোষ নিউরনের লম্বা শাখা পৌছায়) । এভাবে মগজের কোষ থেকে সংকেতের আদান-প্রদান চলে। মাথার খুলির সাথে ‘ইলেকট্রড’ লাগিয়ে উক্ত সংকেতের ছবি তোলা যায় এবং ছবিতে ফুটে ওঠে বিচিত্র তরঙ্গ। তরঙ্গের ধরণটা কেমন হবে সেটা নির্ভর করে মগজ কিভাবে কতটা সক্রিয় তার উপর। মস্তিষ্কের এ তরঙ্গের নাম হচ্ছে ‘ব্রেইন ওয়েভ’ এবং সর্বপ্রথম ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে এটা পরিমাপ করার বৈদ্যুতিক যন্ত আবিষ্কৃত হয়। যন্ত্রটির নাম হলো ইলেকট্রো এনকেফালো গ্রাম সংক্ষেপে ইইজি। বৈজ্ঞানিকগণ নিদ্রাকে প্রধানত ২টি ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমটি নন র‌্যাপিড আই মুভমেন্ট স্লিপ এবং দ্বিতীয়টি র‌্যাপিড আই মুভমেন্ট স্লিপ। নন-রেম স্লিপকে আরো ৪ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে চোখ জড়িয়ে আসে, ক্রমেই ঘুম হতে থাকে। দ্বিতীয় পর্যায়ে গাঢ় ঘুম হয়। তারপর তৃতীয় গভীর ঘুম, এবং চতুর্থ গভীরতম ঘুম হয়। এভাবে প্রথম ভাগের চারটি স্তর পেরিয়ে পাতায় ঢাকা অক্ষিগোলক নড়াচড়া না করলে তাকেই বলে নন-রেম স্লিপ। অপরদিকে এটি যদি দ্রুত নড়াচড়া করে তবে তাকে বলে রেম স্লিপ।

গবেষকগণ লক্ষ্য করেছেন যে, নরেম নিদ্রার সময় মস্তিষ্ক তরঙ্গ ক্রমে ধীর গতি হয়, ঘুমন্ত মানুষটি স্থির থাকে, অক্ষিগোলক নড়াচড়া করে না, শ্বাস-প্রশ্বাস ধীর গতিতে চলে, অনেকেই এই সময় নাক ডাকতে থাকে। চতুর্থ পর্যায়ে ঘুম গভীরতম হয় এবং তখন বৈজ্ঞানিক ক্রিয়াকান্ড চলে সবচেয়ে ধীরে গতিতে। আবার অন্যদিকে রেম নিদ্রা সবচেয়ে হালকা। এখানে অক্ষিগোলক নড়াচড়া করে শ্বাস-প্রস্বাস ছন্দ থাকে, মগজে রক্ত চলাচল বাড়ে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও নড়াচড়া করে। আশ্চর্যের ব্যাপারে এই ঘুমের পর্যায়গুলো চলে চক্রাকারে। যেমন, শুরুতেই ননমের নিদ্রার ১ম, ২য়, ৩য় এবং ৪র্থ পর্যায় ধাপ এভাবে চলে ৯০ মিনিট। এরপর শুরু হয় রেম নিদ্রা যা ৫-২০ মিনিট মাত্র থাকে। আবার শুরু হয় ৯০ মিনিটের পর্যায়ে, তারপর ৫-২০ মিনিটের চক্র চলতে থাকে সারা রাত ব্যাপী।

সুস্বাস্থ্যর অধিকারী একজন মানুষ গড়ে দৈনিক ৮ ঘন্টা ঘুমালে পন্ডিতগণ দেখেছেন যে, এর মধ্যে ৬ ঘন্টা চলে ননরেম ঘুম। এবং ২ ঘন্টা চলে রেম ঘুম। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে গবেষকগণ গড়ে দৈনিক ৮ ঘন্টা ঘুমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। ঘুমের প্রয়োজনীয়তা বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমতে থাকে এবং ৫০ বছর পর ননরেম নিদ্রার অনেকেই বঞ্চিত হন। তাতে কোন অসুবিধা নেই। ননমের নিদ্রাকে বলা হয় গভীরতম নিদ্রা অথবা স্বপ্নহীন ঘুম। এ সময় স্বপ্ন থেকে ঘুমন্ত ব্যক্তিকে ডেকে তোলা সহজ। অপরদিকে রেম নিদ্রা খুব সহজে ঘুমন্ত ব্যক্তিকে ডেকে তোলা যায় না। এ সময় মানুষ স্বপ্ন দেখে এবং সকাল বেলায় তা মনে থাকে। তাই রেম নিদ্রাকে ‘স্বপ্নময় ঘুম’ বলে।

গবেষকগণ দেখেছেন, রেম নিদ্রা শেষ রাতে ঘন ঘন আসে অর্থ্যাৎ ৭০ মিনিট পরপর আসে। সেজন্য মানুষ শেষ রাতেই বেশি স্বপ্ন দেখে এবং তা তুলনামূলকভাবে দীর্ঘস্থায়ী হয়। পন্ডিতগণ উল্লেখ করেছেন, মানুষ প্রতি রাতে রেম নিদ্রা স্তরে ৮০-৯০% সময় স্বপ্ন দেখে কাটায় এবং তা মনে রাখতে পারে। ননমের, নিদ্রা স্তরে ২০-৩০% সময় স্বপ্ন দেখে কিন্তু মনে রাখতে পারে না।

মনোরোগ বিদ্যার জনক প্রখ্যাত চিকিৎসক সিগমান্ত ফ্রয়েড (১৯০০-১৯৫৩) স্বপ্ন নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন যে, মানুষ যখন ঘুমায় তখন তার মনোগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা (Psychic defense mechanism) শিথিল দ্বন্দ (Conflicts) প্রকাশিত হবার জন্য অবচেতন মন (Sub-conscious level) থেকে চেতন মনে(Conscious level) ঠেলে দেয় পরে সেটাই স্বপ্নের মাধ্যমে ছন্দবেশে প্রকাশ পায়। ফ্রয়েড আরো উল্লেখ করেছেন যে, ঐ সমস্ত প্রেরণা দ্বন্দ যদি সরাসরি দিবালোকে বা রাতে স্বপ্নে প্রকাশ পায় তবে মানুষ খুবই অস্বস্তি¡বোধ করবে বিধায় স্বপ্নে ঐগুলো ছদ্মবেশে প্রকাশিত হয়। যে মনোগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা শিশুকাল থেকে সারা জীবন কাজ করে ফ্রয়েড তার নাম দিয়েছেন ‘রিপ্রেশন’ বা ‘দমনকরণ’। তিনি মনে করেন সমস্ত দ্বন্দ, আগ্রাসন ও জৈবিক চাহিদা মানুষ সর্বদা দমন বা রিপ্রেশন করে রাখে, ফলে ঐগুলো ছদ্মবেশে স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

স্বপ্ন সমন্ধে আল কোরআন ও সহীহ হাদিস গ্রন্থসমূহে উল্লেখ আছে। পয়গম্বর ইয়াকুবকে(আ:) আল্লাহ স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। নবী ইউসুফ আ: স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতেন বলে কুরআনে উল্লেখ আছে। আবার নবী ইব্রাহীমকেও (আ:) আল্লাহ স্বপ্নে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম স্বপ্ন সংক্রান্ত যে তিনটি হাদিসে একমত হযেছেন তা নিম্নরুপ:

১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে আমাকে স্বপ্নে দেখে সে সত্যই আমাকে দেখে, কেননা শয়তান আমার আকৃতি ধরতে পারে না। (বুখারী ও মুসলিম)

২. আল্লাহর রাসুল (সা:) বলেছেন, উত্তম স্বপ্ন নবুয়তের ৪৬ অংশের এক অংশ।(বুখারী ও মুসলিম)

৩. নবীজি সা: বলেছেন, সত্য স্বপ্ন আল্লাহ হতে এবং বাজে স্বপ্ন শয়তান হতে আসে। যখন তোমাকে কেউ যা সে ভালবাসে তা দেখে, সে যেন যাদেরকে সে ভালোবাসে তাদের ব্যতীত অন্যের নিকট তা প্রকাশ করে। সে যা অপছন্দ করে সেটা যদি সে স্বপ্নে দেখে, সে যেন তার মন্দ এবং শয়তানের মন্দ থেকে ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাযিম’ তিন বার বলে এবং পার্শ্ব পরিবর্তন করে। এটা কখনো তাকে অনিষ্ট করবে না।(বুখারী ও মুসলিম)। এছাড়া বুখারী , মুসলিম, তিরমিযী ও আবু দাউদ হাদীস গ্রন্থসমূহে আলাদাভাবে বহু হাদীস স্বপ্ন স্বপ্ন সমন্ধে বর্ণিত হয়েছে। শুধু বুখারী শরীফে এ ব্যাপারে একটি স্বপ্নের অধ্যায় রচিত হয়েছে, নাম ‘কিতাবুত তাবীর’। অর্থ্যাৎ স্বপে¦র ব্যাখ্যা সংক্রান্ত বর্ণনা। এখানে মোট ৬০টি হাদীস স্বপ্ন বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।

বিশ্বনবী সা: ডানদিকে পাশ ফিরে ঘুমাতেন এবং বিছানায় শুয়ে দোয়া পড়তেন, ‘আল্লাহুমা বি ইসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া’ অর্থ্যাৎ হে আল্লাহ আমি তোমার নামে মৃত্যুবরণ করছি এবং তোমার নামেই জীবিত হব। তাছাড়া সুরা ফালাক ও সুরা নাস তিনি তিনবার পড়তেন। ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে তিনি পড়তেন, আলহামদুলিল্লাডি আইইয়ানা বা‘দা মা আমা তানা ওয়া ইলাইহি নুশুর অর্থ: আল্লাহর প্রশংসা যিনি আমাদিগকে মৃত্যুর পর পুনরায় জীবন দান করবেন এবং তারই নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

আমরা যতদিন বাচি তার প্রায় এক-তৃতীয়াং সময় কাটাই বিছানায়। বিছানা এমন একটি জায়গা যেখানে আমরা জন্মগ্রহণ করি, আবার মৃত্যুবরণও করি। সুতরাং দেখা যায় বিছানার সাথে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। তাই বিছানা মানুষের পরম বন্ধু। যার সাথে এতটা গভীর সম্পর্ক সেই বিছানাটা কেমন হওয়া উচিত। সেটা কি নরম, শ্কত না এ দুয়ের মাঝামাঝি। ঘুমন্ত অবস্তায় দেহের বিভিন্ন অংশে চাপ কমানোর জন্য রাতে ২০-৩০ বার এপাশ-ওপাশ হতে হয় অধিক নরম বিছানায় ঘুমালে নড়াচড়া কম হয় বলে পিটে ব্যথা হওয়ার আংশকা থাকে।

পিটের ব্যথা নিরাময়ের জন্য চিকিৎসকগণ শক্ত বিছানায় ঘুমাতে বলেন। আসলে নরম ও শ্কত এ দুয়ের মাঝাামাঝি বিছানাই হলো সঠিক। ঘুম ভাঙ্গার পর ধীরে ধীরে বিছানা ছাড়া উচিত। (Brain wave) ক্রমে ধীরে ধীরে গতি পায়, ঘুমন্ত মানুষটি স্থির থাকে, অক্ষিগোলক নড়াচাড়া করে না, শ্বাস-প্রশ্বাস ধীরে গতিতে চলে অনেকেরই।

আরও পড়ুনঃ জেনে নিন কারা রক্তদান করতে পারবেন না।

গণ সচেতনতায় ডিপিআরসি হসপিটাল লিমিটেড

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

18 − 15 =